Google Alert – সেনাবাহিনী
সংগৃহীত ছবি
গত বছরের জুলাইয়ে শুরু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি হয় ৫ আগস্ট। পতন ঘটে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের। দেশের অন্য স্থানের মতো চট্টগ্রামেও বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। রাস্তায় নেমে আসে লাখো জনতা। উল্লাসে মেতে উঠেন শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ, নারী, শিশুরাও। তবে দিনটি শুরু হয়েছিল ঘোর অনিশ্চয়তায়। কড়া কারফিউতে এ দিন নগরবাসীর মনে ছিল অজানা আতঙ্ক। বেলা গড়াতেই সেনাবাহিনীর ছোট ছোট দলের বালুর বস্তার ভেতরে নিরাপত্তা চৌকি বেশি চোখে পড়ে। রাস্তায় ছুটে চলে পুলিশ, র্যাবের সাইরেন বাজানো গাড়ি থেকে সেনাবাহিনী বিজিবির টহল গাড়ি। অলিগলির মোড়ে মোড়ে গুঞ্জন আজ কী হচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষ ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হচ্ছে এমন আগাম খবর নিয়ে সরব ছিলেন।
তবে অনেকে বলতে থাকেন হাসিনা টিকে যাবেন হয়ত। এদিন দুপুর পর্যন্ত নগরজুড়ে ছিল থমথমে পরিবেশ। বিচ্ছিন্নভাবে চলে মিছিলও। ছাত্র-জনতা সবাই ঢাকামুখী। তাই ঢাকা থেকে কী খবর আসে তা নিয়ে উদগ্রীব ছিলেন সবাই। ইন্টারনেট না থাকায় টিভি স্ক্রলেই সবার চোখ। দুপুর ১টার পর টিভি স্ক্রলে খবর দেওয়া হয় সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। লোকজনের মধ্যে পরিবর্তনের ইঙ্গিত স্পষ্ট হতে থাকে। অনেকে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় থাকেন সেনাপ্রধান কী বলেন তার প্রতীক্ষায়। দুপুর ২টার পর শেখ হাসিনার পদত্যাগ করার খবর জানান সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান।
দেশের সব ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া সেনা সদর থেকে লাইভ সম্প্রচার করে সে খবর। বিদ্যুতের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে পদত্যাগের খবর। ভারতে পালিয়ে যাওয়ার খবরও তাৎক্ষণিক ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই লোকজন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। নগরীর বহদ্দারহাট, দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, আন্দরকিল্লা, আগ্রাবাদ, নিউ মার্কেট, জিইসি মোড়সহ নানা জায়গায় লোকজনের উল্লাস। লোকজনের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস দেখতে বাসা-বাড়ি থেকে বেরিয়ে সড়ক পাশে এসে পড়েছেন নারীরাও। ছোট ছোট শিশুদের বড়দের সঙ্গে ছুটতে দেখা গেছে।
জাতীয় পতাকা হাতে ও মাথায় বেঁধে শিক্ষার্থীরা তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়ে চলে আসে সড়কে। নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড় হয়ে উঠে বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা জনতার জড়ো হওয়ার পয়েন্ট। এ সময় তাদের সঙ্গে যোগ দেন বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষ। উল্লসিত মানুষ হাসিনার বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেন। বিভিন্ন স্থানে সেনাসদস্যদের জড়িয়ে ধরে উল্লাস করেন শিক্ষার্থীরা। নানা স্থানে মিষ্টি বিতরণ করা হয়।
নগরীর বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, বায়েজিদ, ২ নম্বর গেট, জিইসি মোড়, কাজীর দেউড়ি, প্রবর্তক মোড়, আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়, হালিশহর বড়পোল, এ কে খান, বন্দর, সল্টগোলা, ইপিজেড, কাটগড় ও পতেঙ্গার বিভিন্ন সড়কে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সর্বস্তরের মানুষ জড়ো হয়। এ সময় অনেকে ব্যাটারি রিকশা ও ট্রাকে চড়ে অলিগলির সড়ক প্রদক্ষিণ করে। কারও হাতে ছিল জাতীয় পতাকা, কেউ লাঠির মাথায় লাল কাপড় বেঁধে শূন্যে উঁচিয়ে সেøাগান দেন। পুরো নগরীর সড়ক আন্দোলনকারী এবং সাধারণ মানুষের দখলে চলে যায়। তারা নেচে-গেয়ে এবং সেøাগানে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করে।
ওই দিন চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা থেকে টাইগার পাস পর্যন্ত সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, স্রোতের মতো মানুষ আসছে। যে যেদিকে খুশি যাচ্ছেন। দুঃশাসন থেকে মুক্তির পর এ যেন আনন্দযাত্রা। শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ, যুবক, বৃদ্ধদের কোলাকুলি করতেও দেখা গেছে। হাসিনার পতন উদযাপনে লোকজনের আনন্দ উচ্ছ্বাস চট্টগ্রামে আর কখনো দেখা যায়নি বলে জানান অনেকেই।
তবে খুশির এই দিনেও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা নগরীর বিভিন্ন স্থানে ওত পেতে ছিল। ৫ আগস্ট বিকালেও ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের গুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। পরে জানা যায়, ছাত্রলীগ যুবলীগের সন্ত্রাসীরা বিকাল পর্যন্ত জানত না হাসিনা পালিয়েছেন। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে না জানার কারণে সন্ত্রাসীরা নগরীর বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে সক্রিয় ছিল। তবে পতনের খবর নিশ্চিত হওয়ার পর ৫ আগস্ট রাত থেকে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের আর দেখা যায়নি নগরীতে। পুলিশের মতো এসব সন্ত্রাসীরাও চলে যায় আত্মগোপনে। যুবলীগ ক্যাডার ওয়ার্ড কমিশনাররাও গা ঢাকা দেন। ৫ আগস্টের পর থেকে মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে ফেলেন বেশিরভাগ নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ কর্মী।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) চট্টগ্রাম নগর কমিটির নেতা রিয়াজুর রহমান সেদিনের অনুভূতি তুলে ধরে সময়ের আলোকে বলেন, হাসিনা পতনের খবর পেয়ে আমি দুপুরে বের হই বাকলিয়া থানার কল্পলোকের বাসা থেকে। এর আগে নানাভাবে খবর নিয়েছি ঢাকার পরিস্থিতি জানতে। ইন্টারনেট ছিল না। কারফিউয়ের কারণে লোকজন বন্দি ছিল। নিরাপত্তার দিক চিন্তা করে আমরাও ছিলাম আত্মগোপনে।
কিন্তু ফ্যাসিস্ট হাসিনা পতনের খবর প্রকাশের পর নগরীর চিত্র পাল্টে যায়। আমি ৫ আগস্ট দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত ঘুরেছি নগরীর বিভিন্ন স্থানে। মানুষের উচ্ছ্বাস দেখেছি। মানুষ প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পেরেছে।
চট্টগ্রামে ১২ নিহত, আহত অনেক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বৃহত্তর চট্টগ্রামে নিহতদের মধ্যে ১২ জনের তথ্য পাওয়া গেছে। তারা পুলিশ ও হাসিনার ক্যাডারবাহিনী ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুলিতে শহিদ হন। নিহতরা হলেন-চট্টগ্রাম কলেজের সম্মান শ্রেণির ছাত্র ও ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম, এমইএস কলেজের ছাত্রশিবির নেতা ফয়সাল আহমেদ শান্ত, আশেকান আউলিয়া ডিগ্রি কলেজের ছাত্র তানভীর ছিদ্দিকী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হৃদয় চন্দ্র তারুয়া, জুতার দোকানের কর্মচারী শহীদুল ইসলাম, রিকশাচালক জামাল উদ্দিন, কাঠমিস্ত্রি মো. ফারুক, দোকান কর্মচারী মাহিন হোসেন সাইমুন, কার্টন ফ্যাক্টরির কর্মচারী মো. আলম, শ্রমিক মো. ইউসুফ, কলেজ শিক্ষার্থী ইশমামুল হক ও শিক্ষার্থী ওমর বিন নুরুল আবছার। চট্টগ্রামে পুলিশ ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত অনেকে পরে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। শত শত আহত জুলাই যোদ্ধা চিকিৎসা নিয়েছেন। গুরুতর আহত অনেকে এখনও চিকিৎসাধীন আছেন।
ঘাতকদের অনেকে অধরা
চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অস্ত্র নিয়ে হামলা করা নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ-যুবলীগের ৪৬ নেতাকর্মীকে শনাক্ত করলেও বেশিরভাগ অধরা। এদের মধ্যে ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে তাদের ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো উদ্ধার হয়নি এক বছরেও। অস্ত্রধারী ২৭ জন ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে এখনও। এমনকি হামলার ঘটনায় নগরীর বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া ৬৩ মামলায় এ পর্যন্ত ১ হাজার ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১০ হাজার ৬০০ জনেরও বেশি ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের। যাদের বেশিরভাগই এখন আত্মগোপনে রয়েছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কর্মকর্তারা এমন কথা জানান। কিন্তু লোকজন মনে করছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলার ঘটনার অনেক আসামি চট্টগ্রামেই আছে। কিন্তু তারা এখনও অধরা।
এমএইচ