Kalbela News | RSS Feed
সমুদ্র বিচার করে না, শুধু গ্রহণ করে, ভালো-মন্দ সবকিছু। একজন বৃদ্ধ জাপানিজ সাগরতীরে দাঁড়িয়ে আছেন, নোনা অশ্রুর ফোঁটা টপটপ করে সাগরের নোনা জলে মিশে যাচ্ছে। ঢেউ তার গোড়ালির ওপর দিয়ে, তারপর হাঁটুর ওপর দিয়ে, তাকে ভেতরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি অবলীলায় হেঁটে ঢুকে যাচ্ছেন সাগরের অথৈ জলে। মনুষ্য বসতিতে ইতিহাসের প্রথম পারমাণবিক বোমা ‘লিটল বয়ে’র বিস্ফোরণে তার স্ত্রী ও সন্তানরা চিরতরে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। তার দশ বছর পর সাগর পারের ওই মানুষটিকে কেউ আত্মাহুতি থেকে থামাতে পারেনি। তিনি একটা চিরকুটে লিখে গিয়েছিলেন, ‘আমি তাদের খুঁজতে যাচ্ছি।’ সেদিন সমুদ্র কেবল একজন ভেঙে পড়া মানুষকেই গ্রাস করেনি; বরং নীরবে ডুবে যাওয়া লাখ লাখ অব্যক্ত সত্যকেও গ্রাস করেছিল। বোমায় মৃতদের কবর দেওয়া হয়েছিল, আর জীবনস্মৃতরা হেঁটে চলছিল এলোমেলো। এমন অগণিত ‘হিবাকুশা’ (Hibakusha) যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেননি—শুধু শারীরিক নয়, লজ্জা, একাকিত্ব, বেঁচে থাকার অপরাধবোধ; তারা সেতোনাইকাই (Setonaikai) সাগরে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। হিবাকুশা একটি জাপানি শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ ‘বোমা-আক্রান্ত ব্যক্তি বা (তেজস্ক্রিয়তায়) আক্রান্ত ব্যক্তি’। এটি বিশেষভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের বোঝায়। এ শব্দটির একটি গভীর ঐতিহাসিক এবং চিকিৎসাগত তাৎপর্য রয়েছে, যা কেবল তাৎক্ষণিক বিস্ফোরণে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদেরই নয়; বরং যারা রেডিয়েশনজনিত অসুস্থতা এবং দীর্ঘমেয়াদি অন্যান্য স্বাস্থ্যগত প্রভাবে ভুগছিলেন, তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করে।
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত হয় প্লুটোনিয়াম সমৃদ্ধ পারমাণবিক বোমা ‘ফ্যাট ম্যান’। বোমা হামলার আগে হিরোশিমার আনুমানিক জনসংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৬০ হাজার। বোমা হামলায় মৃত্যুবরণ করেন ১ লাখ ৪০ হাজার জন (৩৮%), আহত হন ৮০ হাজার (২২%)। নাগাসাকির আনুমানিক জনসংখ্যা ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার, পরমাণু বোমা হামলায় নিহত হন ৭০ হাজার (২৮%), আহত হন ৮০ হাজার জন (৩২%) (৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৫)। রেড ক্রসের তথ্য অনুযায়ী, হিরোশিমার ৯০% চিকিৎসক এবং নার্স কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নিহত হন অথবা অক্ষম হয়ে পড়েন। যে কজন হিবাকুশা চিকিৎসক বেঁচে ছিলেন তাদের মধ্যে ডা. মিচিহিকো হাচিয়া একজন। তিনি একটি একটি মর্মস্পর্শী ডায়েরি লিখেছিলেন, ‘হিরোশিমা ডায়েরি: দ্য জার্নাল অব আ জাপানিজ ফিজিশিয়ান, ৬ আগস্ট ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫’। তিনি লিখছেন, ‘আমি একজন মানুষকে দেখেছি যার চোখের বল তার গালের নিচে ঝুলছিল। একজন মহিলা তার দগ্ধ শিশুটিকে আঁকড়ে ধরেছিলেন, তার চামড়া গ্লোভসের মতো খসে পড়ছিল।’ রেড ক্রস হাসপাতালের নার্স তোশিকো সায়েকি বলেছিলেন, ‘একজন ছেলে আমার কবজি ধরে ভিক্ষুকের মতো বলছিল, বোন, আমার হাত কেটে ফেলুন—ব্যথা আমাকে জীবন্ত খেয়ে ফেলছে।’ কিন্তু আমার কাছে মরফিন বা চূড়ান্ত ব্যথানাশক কোনো ওষুধ ছিল না। আমি তাকে দিয়েছিলাম কামড়ানোর জন্য একটি কাঠের লাঠি। সে লাঠিটি ছিল হিরোশিমার প্রথম মাসে ৪২ হাজার রেকর্ডকৃত ওষুধবিহীন ব্যথা-চিকিৎসার একটি মাত্র উদাহরণ। রেড ক্রস এটিকে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার সবচেয়ে বড় অপ্রতিরোধ্য ব্যথা সংকট বলে অভিহিত করেছে। ওই ডায়েরি, ওই লাঠি ‘হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে’ সংরক্ষিত আছে।
হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার স্বাস্থ্য প্রভাব অধ্যয়নের জন্য মার্কিন পরমাণু শক্তি কমিশনের (AEC) মাধ্যমে জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমির অর্থায়নে ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে ‘অ্যাটমিক বোমা ক্যাজুয়ালটি কমিশন’ (ABCC) প্রতিষ্ঠিত হয়। পরিচালনার দায়িত্বে ছিল ‘দখলদার মার্কিন কর্তৃপক্ষ’ (১৯৪৫-১৯৫২)। কিন্তু এটি জাপানের কোনো আইনের দ্বারা সমর্থিত ছিল না; সমালোচকরা এটিকে ‘গবেষণা উপনিবেশ’ বলে অভিহিত করেছিলেন, কারণ বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা (হিবাকুশা) তীব্র গবেষণার বিষয় হয়ে ওঠে, অথচ তাদের জন্য এতে কোনো চিকিৎসা সহায়তা বা কর্মসূচি ছিল না। ‘হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে’ সংরক্ষিত একজন হিবাকুশার সাক্ষ্যে পাওয়া যায়, ‘এবিসিসি আমাদের ল্যাবরেটরির ইঁদুরের মতো অধ্যয়ন করছিল। আরইআরএফ (RERF) আসার পরই কেবল আমরা মানুষ হয়ে উঠি।’
হিবাকুশারা এবং জাপানি বিজ্ঞানীরা যৌথ নিয়ন্ত্রণ দাবি করে আসছিলেন। ১৯৭৫ সালে জাপানি নাগরিক আইনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র-জাপানের যৌথ তহবিলের মাধ্যমে এবিসিসিকে ‘রেডিয়েশন ইফেক্টস রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ (আরইআরএফ) হিসেবে পুনর্গঠিত করা হয়।
বোমা দুটি বাতাসে বিস্ফোরিত হয়েছিল; ‘এপিসেন্টার’ (epicenter) হলো বাতাসের সেই বিন্দু যেখানে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, আর ‘হাইপোসেন্টার’ (hypocenter) হলো বায়ুতে বিস্ফোরণের ঠিক নিচে মাটিতে অবস্থিত বিন্দু; এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ এটি ‘গ্রাউন্ড জিরো’ চিহ্নিত করে, যেটি ভূপৃষ্ঠের ওপর থাকা ব্যক্তিদের জন্য সর্বাধিক সরাসরি প্রভাব, তাপ, শকওয়েভ এবং প্রাথমিক রেডিয়েশনের সংস্পর্শে আসার কেন্দ্রবিন্দু। হাইপোসেন্টারের ৫০০ মিটারের মধ্যে মৃত্যুর হার ছিল প্রায় ১০০% এবং ১,০০০ মিটারের মধ্যে ছিল প্রায় ৯০%।
উপরোক্ত গবেষণা থেকে জানা যায় যে, তাৎক্ষণিকভাবে যারা নিহত হন, তাদের মৃত্যুর কারণ ছিল :
১. ব্লাস্ট (blast) (৫০%) (হিরোশিমার হাইপোসেন্টার থেকে দূরত্ব: ৪ কিমি; নাগাসাকির ৫ কিমি)
২. তাপ (heat) (৩৫%) (হিরোশিমার হাইপোসেন্টার থেকে দূরত্ব: ৩.৩ কিমি; নাগাসাকির ৪ কিমি)
৩. বিকিরণ (radiation) (১৫%), গামা রশ্মি নিউট্রন (হিরোশিমার হাইপোসেন্টার থেকে দূরত্ব:
২ কিমি; নাগাসাকির ২.৫ কিমি)
ব্লাস্ট ছিল সুপারসনিক শকওয়েভের ধাক্কা (গতিবেগ প্রায় ১,০০০ কিমি/ঘণ্টা), যা ভবনগুলোকে সমতল করে দিয়েছিল, ধ্বংসাবশেষ চতুর্দিকে নিক্ষেপ করেছিল, গাছগুলোকে বর্শায় পরিণত করেছিল, মানুষদের বিশেষত শিশুদের আকাশে ছুড়ে মেরেছিল এবং তাদের দেহ ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছিল। ১৯৪৫ সালের শেষ নাগাদ নিহতদের মধ্যে ৩৮ হাজার শিশু ছিল। হিবাকুশাদের (এবং স্পষ্টতই প্রাথমিকভাবে হতাহতদের) একটি উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যাতাত্ত্বিক ধরন হলো—বোমা হামলার সময় শহরগুলোতে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী পুরুষদের উপস্থিতি কম ছিল। এর কারণ হিসেবে অনেকে সামরিক দায়িত্ব বা যুদ্ধকালীন কাজের জন্য তাদের বাইরে থাকার কথা বলে থাকে। এর অর্থ হলো, আনুপাতিকভাবে, শহরগুলোতে উপস্থিত বেসামরিক হতাহতের সংখ্যার একটি বড় অংশ ছিল নারী, শিশু এবং বয়স্ক পুরুষ। শিশু হিবাকুশা সাদাকো সাসাকির তখন বয়স ছিল মাত্র আড়াই বছর। বারো বছর বয়সে তার লিউকেমিয়া ধরা পড়ে এবং হাসপাতালের একজন রুমমেট তাকে ‘জাপানি কিংবদন্তি’ জানিয়ে বলেছিলেন, যে ব্যক্তি ১,০০০টি কাগজের সারস বানাবে, তার ইচ্ছা পূরণ হবে। সাদাকো তার অসুস্থতা থেকে সেরে ওঠার আশায় হাসপাতালের বিছানায় বসে নিরলসভাবে কাগজের সারস বানিয়ে যাচ্ছিল। হাজারখানেক সারস বানাতে বানাতে সে মারা যায়। তার গল্প বিশ্বজুড়ে গভীরভাবে অনুরণিত হয়। আজও মানুষ আশা ও স্মরণের নিদর্শন হিসেবে হিরোশিমায় তার স্মৃতিস্তম্ভে কাগজের সারস নিবেদন করে।
এবিসিসি ও আরইআরএফ গবেষণা কার্যক্রমের একটি প্রধান উপাদান হচ্ছে Life Span Study (LSS) অর্থাৎ ব্যক্তির সমগ্র জীবনজুড়ে তার তথ্য সংগ্রহ করা। তাৎক্ষণিকভাবে যারা মৃত্যুবরণ করেছিলেন তাদের ১৫%-এর কারণ ছিল রেডিয়েশন। এলএসএস-এর উদ্দেশ্য ছিল পারমাণবিক বোমার রেডিয়েশন (বিকিরণ)-এর সংস্পর্শে আসার ফলে ব্যক্তির ‘দীর্ঘমেয়াদি’ স্বাস্থ্য পরিণতি যাচাই করা। বিস্ফোরণের সময় হিরোশিমা/নাগাসাকির হাইপোসেন্টারের আনুমানিক ১০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা সকল হিবাকুশাকে গবেষণার নমুনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়; সংখ্যাটা ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার জন। তাদের মধ্যে হাইপোসেন্টার থেকে যাদের অবস্থানগত দূরত্ব রেকর্ডের মাধ্যমে নিশ্চিত করা গিয়েছিল এবং শিল্ডিং (shielding) অর্থাৎ ঢাল অনুযায়ী যাদের রেডিয়েশন ডোজ অনুমান/পরিমাপ করা সম্ভব ছিল, তাদের ‘মাস্টার নমুনা’র জন্য বাছাই করা হয়; সংখ্যাটা ছিল ১ লাখ ৯৫ হাজার জন। বাদ দেওয়া হয় ১০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে যারা ছিলেন এবং যাদের তথ্য অসম্পূর্ণ ছিল তাদের। উল্লেখ্য, শিল্ডিং রেডিয়েশনের ডোজকে প্রভাবিত করে। উদাহরণ: ১ কিমি দূরে একটি কংক্রিট ভবনের ভেতরে একজন বেঁচে থাকা ব্যক্তি একই দূরত্বে বাইরে থাকা ব্যক্তির তুলনায় আনুমানিক ৫০% কম রেডিয়েশন ডোজ পাবেন।
হিসেবটা এমন:
ঘরের ভেতরে : কংক্রিটের ঘরে (৫০% ডোজ হ্রাস), কাঠের ঘরে (২০% হ্রাস)।
বাইরে : কোনো শিল্ডিং নেই (১০০% এক্সপোজার)।
শারীরিক ভঙ্গি : দাঁড়িয়ে থাকা বনাম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভাঁজ করে রাখা (আরও সামঞ্জস্যপূর্ণ ডোজ)।
মাস্টার নমুনার একটি উপসেট হিসেবে এলএসএস-এর দল (cohort) তৈরি করা হয়। এই দলে ছিল ১ লাখ ২০ হাজার জন। এই দলের ভেতরে ছিল ২টি উপদল:
১. এক্সপোজড গ্রুপ (৮৬ হাজার জন) : ১০ কিমি বা তার কম দূরত্বে অবস্থানকারী যারা ০.০০৫ গ্রে (Gray) বা তার বেশি ডোজের রেডিয়েশনের সংস্পর্শে এসেছেন (শিল্ডিংয়ের হিসেব বিবেচনা করে)।
২. কন্ট্রোল (নিয়ন্ত্রণ) গ্রুপ (৩৪ হাজার জন) : ৩ কিমি বা তার বেশি দূরত্বে অবস্থানকারী যারা ০.০০৫ গ্রে (Gray)-এর কম ডোজের রেডিয়েশনের সংস্পর্শে এসেছেন অথবা বিলম্বে প্রবেশ করেছেন (অর্থাৎ যাদের রেডিয়েশনের ডোজ নগণ্য বা একেবারেই নেই)।
রেডিয়েশন ডোজের তীব্রতা বোঝার জন্য একটি এক্স-রের উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে। বুকের এক্স-রের প্রতি ছবিতে ০.০২-০.১ মিলি-গ্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। টোকিও থেকে নিউইয়র্ক একবার যাওয়া-আসা করলে একজন বিমান যাত্রী ০.১-০.২ মিলি-গ্রে রেডিয়েশন ডোজের সংস্পর্শে আসেন। পক্ষান্তরে, ১ কিলোমিটারে ভেতরে থাকা হিবাকুশারা একটি এক্স-রের চেয়ে ২০ হাজার গুণ বেশি রেডিয়েশন ডোজের শিকার হয়েছিলেন। এলএসএস গবেষণার গুরত্বপূর্ণ ফলাফল নিম্নরূপ:
১. সলিড (কঠিন) ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি : রেডিয়েশন কঠিন ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে (যেমন, ফুসফুস, স্তন, পাকস্থলী)। প্রতি ১ গ্রে রেডিয়েশনের সংস্পর্শ ১০% ‘অতিরিক্ত আপেক্ষিক ঝুঁকি’ (ERR) তৈরি করে।
২. লিউকেমিয়া (ব্লাড ক্যান্সার) স্পাইক (প্রথম দিকে এবং বিলম্বে প্রাদুর্ভূত) : মারাত্মক লিউকেমিয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকি, এক্সপোজারের ৫-১৫ বছর পরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। অনূর্ধ্ব-২০ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে প্রতি ১ গ্রে রেডিয়েশনের সংস্পর্শ ৪.৫% ‘অতিরিক্ত আপেক্ষিক ঝুঁকি’ (ERR) তৈরি করে।
৩. ডোজের সাথে প্রতিক্রিয়ার মাত্রার সম্পর্ক: গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, সামান্য পরিমাণ রেডিয়েশনও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। এর কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই এবং উচ্চতর এক্সপোজারের সঙ্গে বিপদ ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়; এমনকি ডোজ ০.১-০.৫ গ্রে হলেও। ০.৫ গ্রে এক্সপোজার আজীবন কঠিন ক্যান্সারের ঝুঁকি ৫% বৃদ্ধি করে।
৪. হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি : রেডিয়েশনের এথেরোস্ক্লেরোসিস (রক্তনালিতে বাধাগ্রস্ত রক্তপ্রবাহ) এবং হৃদরোগকে ত্বরান্বিত করে। প্রতি ১ গ্রে রেডিয়েশনের সংস্পর্শ স্ট্রোক/হার্ট ফেইলিওরের ০.১২% ‘অতিরিক্ত আপেক্ষিক ঝুঁকি’ (ERR) তৈরি করে।
৫. ট্রান্সজেনারেশনাল প্রভাব (জেনেটিক মিউটেশনের অভাব): বংশধরদের মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য কোনো জেনেটিক মিউটেশন ঘটেনি। অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে রেডিয়েশনের প্রভাব সঞ্চারিত হয়নি।
এলএসএস-এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, রেডিয়েশনের নিষ্ঠুরতা পরিমাপযোগ্য; প্রতি ০.১ গ্রে রেডিয়েশন একজন জীবিত ব্যক্তির স্বাস্থ্যের ১% গ্রাস করে ফেলে; শুধু টিউমারের মাধ্যমে নয়; বরং হার্ট ফেইলিওর এবং সামাজিক কুসংস্কারের ছোবলের মাধ্যমেও। এলএসএস রেডিয়েশনের বিলম্বিত প্রভাব বোঝার এবং রেডিয়েশন থেকে সুরক্ষা সম্পর্কিত জনস্বাস্থ্য নীতি প্রণয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
এলএসএস ছাড়াও আরইআরএফ স্বতন্ত্র নমুনা জনসংখ্যা নিয়ে অন্যান্য গবেষণা পরিচালনা করে, তাতে দেখা যায় ‘কৃষ্ণবৃষ্টি’ (Black Rain)-এর শিকার প্রায় ৯,৫০০ জনের অনেকেই দশক পরে লিউকেমিয়া, থাইরয়েড ক্যান্সার এবং বিরল জেনেটিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন; বিস্ফোরণের পর হিরোশিমার বাইরের গ্রামগুলোতে এই তেজস্ক্রিয় ‘কৃষ্ণবৃষ্টি’ পড়েছিল। হিবাকুশা পরিবারগুলোকে কলঙ্কিত মনে করা হয়েছিল—‘দূষণের’ ভয়ে কেউ তাদের বিয়ে করতে চায়নি, এমনকি তাদের সন্তানদের কাছেও নিজ সন্তানদের বিয়ে দিতে চায়নি। অন্যদিকে, গর্ভবতী হিবাকুশারা পরে এমন শিশুদের জন্ম দিয়েছিলেন যাদের চোখ ছিল না, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা মস্তিষ্ক ছিল না বা মস্তিষ্কের আর বিকাশ ঘটেনি। ধাত্রীরা ফিসফিস করে বলেছিল ‘দানব শিশু’। অনেককে পরিত্যক্ত করা হয়েছিল। অন্যদের লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, তাদের বাবা-মা তাদের অস্তিত্ব স্বীকার করতে লজ্জা পেয়েছিলেন। ফলে হিবাকুশাদের সামাজিক বৈষম্যের ভারী বোঝাও বহন করতে হয়েছে। তাদের প্রায়ই করুণা এবং ভয়ের মিশ্রণের সঙ্গে দেখা হতো, একটি অদৃশ্য সংক্রামকতার বাহক হিসেবে দেখা হতো। এটি তাদের কষ্টকে একটি একাকী যাত্রায় পরিণত করেছিল, প্রায়ই নীরবে সহ্য করা হতো, তাদের শারীরিক রোগগুলো বিচ্ছিন্নতার একটি বিস্তৃত অনুভূতির দ্বারা আরও জটিল আকার ধারণ করেছিল।
এই অব্যক্ত যন্ত্রণা থেকে ১৯৫৬ সালে ‘নিহন হিদানকিও’ (জাপান কনফেডারেশন অব অ্যাটমিক এবং হাইড্রোজেন বোমা ভুক্তভোগী সংস্থা) জন্মগ্রহণ করেছিল। এটি একটি জাতীয়, বেসরকারি সংস্থা যা হিবাকুশারা নিজেরাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর প্রাথমিক লক্ষ্য হলো, পারমাণবিক বোমা থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের অধিকার ও সমর্থনের পক্ষে কথা বলা এবং বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্র নির্মূলের জন্য অবিরাম পরিশ্রম করা। এর মাধ্যমে একজন হিবাকুশা আরেকজন হিবাকুশার কাছে পৌঁছান, তাদের ক্ষতবিক্ষত হাত সংহতিতে আঁকড়ে ধরেন। তারা তাদের নিজস্ব সমর্থনের স্থপতি ছিলেন, ব্যক্তিগত দুর্ভোগকে একটি সম্মিলিত শক্তিতে পরিণত করেছিলেন। তাদের সংগ্রহে ছিল ব্যক্তিগত সাক্ষ্যের বিশাল ভান্ডার, যা একটি ছিন্নভিন্ন পৃথিবী থেকে মূল্যবান টুকরোর মতো সংগৃহীত। হিবাকুশাদের সাক্ষ্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১৭ সালে জাতিসংঘের পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি (৯৩টি দেশ দ্বারা অনুমোদিত) পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করে, কিন্তু পারমাণবিক রাষ্ট্র (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইত্যাদি) এটি বয়কট করে। হিদানকিওর আইনজীবী সেতসুকো থার্লো, যিন নিজেও একজন হিবাকুশা, জাতিসংঘে ওই চুক্তির আলোচনার সময় তার দগ্ধ আত্মীয়দের ছবি দেখিয়ে ভাষণ দিয়ে আলোড়ন তৈরি করেছিলেন। ২৮ বছর বয়সী ডা. শুনতারো হিদা বিস্ফোরণের পর শত শত রোগীর চিকিৎসা করেছিলেন, যখন তার নিজের শরীর তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছিল। রেডিয়েশন তাকে জীবন্ত খেয়ে ফেলছিল; কিন্তু তিনি কাজ করেই যাচ্ছিলেন। তার ঐতিহাসিক ডায়েরি ‘দ্য অ্যাটমিক বোম অ্যান্ড মাই এন্ডুরিং বডি’-তে তিনি লিখছেন, ‘৭ আগস্ট, ১৯৪৫। হাসপাতাল নাই হয়ে গেছে, গোটা শহরও। আমার হাতকাঁপা থামছে না। আমি লণ্ঠনের আলোয় লিখছি, চারপাশে এখনো জ্বলন্ত মানুষ। আমি একজন ডাক্তার। আমার জানা উচিত কীভাবে তাদের বাঁচাতে হয়। কিন্তু আজ, আমার জীবনে প্রথমবারের মতো… আমি বুঝতে পারছি না।’ তিনি বেঁচে ছিলেন কিন্তু পরবর্তী ৬০ বছর লিউকেমিয়া, টিউমার এবং অসহ্য যন্ত্রণার সাথে লড়াই করে কাটিয়েছিলেন। ২০০৪ সালে তিনি লিখছেন, লিউকেমিয়া ফিরে এসেছে। কিন্তু আজ একজন তরুণ কর্মী আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এভাবে বেঁচে থাকার কোনো মানে আছে? আমি তাকে বললাম: ‘হ্যাঁ, আছে। কারণ তুমি শুনছো।’ হিবাকুশাদের যন্ত্রণা ও অধিকারের কথা তিনি শুনিয়েছেন। ১৯৯০-এর দশকের মামলায় তিনি আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যা ‘কৃষ্ণবৃষ্টি’র শিকারদের সরকারি স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করেছিল।
হিবাকুশাদের ত্বকের কেলয়েড (keloid)-এর দাগ পারমাণবিক সহিংসতার প্রতীক হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালে লাইফ ম্যাগাজিন হিবাকুশাদের পোড়াদেহের গ্রাফিক ছবি প্রকাশ করে, যা বিশ্বকে হতবাক করে দেয়। ১৯৪৫ সালে ১৩ বছর বয়সী শিগেকো সাসামোরি ১৯৫৫ সালের এক সংবাদ সম্মেলনে তার হাতা গুটিয়ে কেলয়েডের দাগ প্রকাশ করেছিলেন যাকে তিনি ‘আমার শরীরের প্রতিবাদ’ বলেছিলেন। পরে তিনি একজন নার্স হয়েছিলেন, বোমাক্রান্ত রোগীদের ফিসফিসিয়ে বলতেন, ‘তোমাদের ক্ষত প্রমাণ করে যে পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে হবে।’
নোবেল কমিটি অবশেষে হিবাকুশাদের সম্মানিত করেছে। ২০২৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার গেছে হিবাকুশাদের হাতে, তাদের সংগঠন ‘নিহন হিদানকিও’ (Nihon Hidankyo)-র করকমলে। সংগঠনটির আইনজীবী সেতসুকো থার্লো নোবেল গ্রহণের বক্তৃতায় বলেন, ‘ভুক্তভোগী হিসেবে আসিনি। আমরা এমন কিছুর সাক্ষী হয়ে এসেছি, যা মানবজাতি অবশ্যই আর কখনো পুনরাবৃত্তি করবে না।’ এটি কোনো বিজয়ের ল্যাপ ছিল না; এটি ছিল একটি আদালত কক্ষ এবং প্রামাণ্যসমূহ তাদের দেহে এবং নথিতে লেখা ছিল।
পারমাণবিক বোমার জনক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদার্থবিদ জে. রবার্ট ওপেনহাইমার। হিবাকুশা আকিহিরো তাকাহাশি (তখন ১৪ বছর বয়সী) ১৯৫১ সালের টোকিও সম্মেলনে ওপেনহাইমারের মুখোমুখি হয়েছিলেন, আমি তাকে আমার ক্ষতবিক্ষত হাত দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘তুমি এটা কেন তৈরি করলে?’ সে আমার দগ্ধ হাতের দিকে তাকিয়ে ছিল, তারপর ফিসফিস করে বলেছিল, ‘যুদ্ধ শেষ করার জন্য।’ অথচ, ইউরোপে মিত্রবাহিনীর অভিযান বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার বলেছিলেন, ‘আমি দুটি কারণে এর বিরুদ্ধে ছিলাম। প্রথমত, জাপানিরা আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত ছিল এবং তাদের ওপর সেই ভয়াবহ জিনিস দিয়ে আঘাত করার প্রয়োজন ছিল না। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশকে এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করতে প্রথম দেখা আমার ঘৃণার বিষয় ছিল।’ আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘যদি হিরোশিমা ও নাগাসাকির পূর্বাভাস পেতাম, তাহলে আমি ১৯০৫ সালে আমার সূত্রটি ছিঁড়ে ফেলতাম। এর চেয়ে আমার একজন ঘড়ি প্রস্তুতকারক হওয়া ভালো ছিল।’
ওপেনহাইমার কখনো আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাননি। তার বীরত্বগাথা ‘ওপেনহাইমার’ ২০২৪ সালের অস্কারে সেরা চলচ্চিত্রসহ অনেক পুরস্কার জিতে নিয়েছে। হিরোশিমা ও নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলার জন্য আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে কাউকে কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার বা শাস্তি দেওয়া হয়নি। নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক কেনজাবুরো ওয়ে বলেছেন, ‘হিরোশিমা শান্তিবিহীন অপরাধ।’ অথচ ‘টোকিও ট্রায়ালে’র মাধ্যমে জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছে। ১১ জনের মধ্যে ভারতীয় বাঙালি আইনবিদ রাধাবিনোদ পালই ছিলেন একমাত্র বিচারক যিনি জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি এই বিচারকে ‘বিজয়ীদের বিচার’ বলে সমালোচনা করেছিলেন। ইয়াসুকুনি মন্দিরে রাধাবিনোদ পালের একটি স্মৃতিস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে।
পারমাণবিক বোমা হিবাকুশাদের দেহকে যন্ত্রণাদায়ক আর্কাইভে রূপান্তরিত করেছিল, যা থেকে তাদের মন মরিয়া হয়ে পালাতে চেয়েছিল, কিন্তু রক্তমাংস কখনই সত্যিকার অর্থে তা ভুলতে দেয়নি। আসুন, আমরা কেবল বিস্ফোরণের কথা স্মরণ না করে হিবাকুশাদের দেহে সেই মুহূর্তের প্রতিধ্বনি অনুভব করি। এটি এমন একটি বিশ্বের প্রতি আমাদের অটল অঙ্গীকার দাবি করি, যেখানে এ ধরনের ভয়ংকর স্মৃতি আর কখনো আমাদের তাড়া করবে না। হিবাকুশার নোবেল শেষ কথা নয় এটি একটি দাবি; তাদের দেহ প্রমাণ বহন করে; এখন বিশ্বকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক : বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ, জনস্বাস্থ্য ও হাসপাতাল প্রশাসন বিশেষজ্ঞ, গীতিকার এবং প্রবন্ধকার