পাল্টা শুল্কে বাংলাদেশে আপাতত স্বস্তি, তবে.. – DW – 08.08.2025

Google Alert – বাংলাদেশ

আপাতত স্বস্তি এসেছে বাংলাদেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শেষ গত ৩১ জুলাই বাংলাদেশসহ ৭০টি দেশের ওপর নতুন হারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছেন যা ৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ওপর তিনি ২০ শতাংশ হারে পাল্টা শুল্কারোপ করেছেন যা গত ৮ জুলাই প্রস্তাবিত ৩৫ শতাংশের অর্ধেকের কাছাকাছি। অবশ্য এ বছর ২ এপ্রিল যখন বিভিন্ন দেশের ওপর প্রথম তিনি পাল্টা শুল্কারোপ করেছিলেন, তখন বাংলাদেশের ওপর সাড়ে ৩৭ শতাংশ হারে এই শুল্ক ধার্য করা হয়েছিল।

এই পাল্টা শুল্ক নির্ধারণে ট্রাম্প প্রশাসন প্রথমে এক উদ্ভট সূত্র প্রয়োগ করেছিল। তাই একটি দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতিকে সেই দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি দিয়ে ভাগ করে যে সংখ্যা পাওয়া যায়, সেটার অর্ধেককে শতকরায় রূপান্তর করে ঐ দেশের জন্য পাল্টা শুল্ক হিসেবে ধরা হয়। ট্রাম্প অবশ্য প্রথম দফাতেই মানে ৯ এপ্রিল থেকে চীন বাদে সকল দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। অন্যভাবে বললে, তিনি দেশগুলোকে তিন মাস সময় দেন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমঝোতায় এসে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি করে শুল্ক কমানোর। আর চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি বাড়ানোসহ দেশটিকে নানা ধরণের সুযোগ-সুবিধা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার জন্য। ফলে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ দৌঁড়ঝাপ শুরু করে সমঝোতার জন্য।

তিন মাস আসলেই খুব কম সময়…

কিন্তু তিন মাস আসলেই খুব কম সময় বিশেষত বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর ও সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশের সাথে কোনো বাণিজ্য সমঝোতা চুক্তিতে উপনীত হওয়া। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তিকে শুধু পণ্য ও সেবা আমদানি-রপ্তানি সহজীকরণের একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) হিসেবে বিবেচনা করে না, বরং বিবেচনা করে নিবিড় অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার সমঝোতা হিসেবে। এই চুক্তির মধ্যে পণ্য ও সেবা বা পরিষেবা খাতের শুল্ক ছাড়ই নয়, বরং সরকারি ক্রয়, বিনিয়োগ সহজীকরণ, মেধাস্বত্ব আইন প্রয়োগ, পরিবেশ সুরক্ষা, শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা ইত্যাদি অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা ও দরকষাকষির পর এই দ্বিপক্ষীয় এফটিএ স্বাক্ষর হয়ে থাকে। সে কারণেই এখন পর্যন্ত মাত্র ২০টি দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় এফটিএ হয়েছে।

ট্রাম্প প্রথম দফায় বা ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বিভিন্ন দেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় এফটিএ করার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তাঁর বাণিজ্য নীতির কথাই ছিল বহুপক্ষীয় নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রত্যেক দেশকে দ্বিপক্ষীয়ভিত্তিতে দরকষাকষির মাধ্যমে বাণিজ্য-সুবিধা নিতে হবে। তবে তার ঐ চার বছরে বা ২০২০ পর্যন্ত কোনো দেশের সাথেই বিএফটিএ হয়নি প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের এফটিও কাঠামোর জটিল ও বিস্তৃত পরিধির জন্য।

চলতি দফায় দায়িত্ব নিয়ে ট্রাম্প অত্যন্ত আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করেছেন। তিনি আর দীর্ঘ আলোচনা ও দরকষাকষির মধ্য দিয়ে বিএফটিএ করার নীতি বাদ দিয়ে একপ্রকার জবরদস্তিমূলকভাবে বাণিজ্য চুক্তি করানোর পথ বেছে নিয়েছেন। এ কাজে তার প্রধান হাতিয়ার হলো উচ্চহারে আমদানি শুল্কারোপ করা। দৃশ্যত তার এই হাতিয়ার কাজে লাগতে শুরু করেছে ।

বাণিজ্য উপদেষ্টার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রীতিমতো গলদঘর্ম হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এফটিএ কাঠামো মেনে নিয়ে নানা ধরনের ছাড় দিয়ে পাল্টা শুল্কের হার ২০ শতাংশ নির্ধারণে ট্রাম্প প্রশাসনকে রাজী করাতে পেরেছে। একই হার প্রযোজ্য হচ্ছে শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামের জন্য, যেখানে ভারতের জন্য এই হার ২৫ শতাংশ। তবে পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়ার জন্য এই হার ১৯ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে এতদিন গড়ে সাড়ে ১৫ শতাংশ হারে শুল্কারোপ করে আসছিল। এর সঙ্গে ২০ শতাংশ শুল্কহার যুক্ত হয়ে গড় আমদানি শুল্ক দাঁড়াবে ৩৫ শতাংশে। তবে পণ্যভেদে শুল্কহারও এর চেয়ে কম বা বেশি হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানির ওপর গড়ে মাত্র ছয় শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করে থাকে। আর পণ্যভেদে শুল্ক হার শূন্য থেকে ৬১১ শতাংশ পর্যন্ত ল্কআছে। তবে এখন থেকে তা আর থাকবে না। কেননা, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানিতে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ।

পাশাপাশি আগামী কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানির কাছ থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ ক্রয় করাসহ সে দেশ থেকে সামরিক সরঞ্জাম, গম, তুলা, ভোজ্য তেল ও জ্বালানি তেল আমদানি বাড়ানোর বিষয়েও এক ধরনের প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে।

এগুলো ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিনিয়োগ আসার প্রক্রিয়া সহজ করা, মেধাস্বত্ব বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করা, উপাত্ত সুরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিবেচনায় নেয়াসহ বেশ কিছু ‘অশুল্ক পদক্ষেপ’ গ্রহণকেও পাল্টা শুল্ক ছাড়ের শর্ত হিসেবে মেনে নিতে হয়েছে।

ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক: কী করবে ইউরোপ?

To view this video please enable JavaScript, and consider upgrading to a web browser that supports HTML5 video

প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণের তেমন কোনো সুযোগ পাওয়া গেল না:

যদিও শেষ পর্যন্ত ‘বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র পারস্পরিক বাণিজ্য চুক্তি’-তে কী থাকছে, তা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে এটা মোটামুটি পরিস্কার যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় এফটিএ করতে গেলে তাতে যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হতো, এখন প্রায় সেসবই করতে হচ্ছে। পার্থক্য হলো, এখন আর সময় নিয়ে দরকষাকষির কোনো সুযোগ এবং এসব পদক্ষেপের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণের তেমন কোনো সুযোগ পাওয়া গেল না।

অথচ আজ থেকে এক যুগে আগে ওবামা প্রশাসন যখন রানা প্লাজা ভবন ধ্বসে ১,১০০-র বেশি পোশাক শিল্প শ্রমিক প্রাণ হারানো এবং আরো কয়েক হাজার পঙ্গু হওয়ার জের ধরে শ্রম অধিকার রক্ষার ব্যর্থতায় বাংলাদেশকে দেয়া জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স (জিএসপি) সুবিধা স্থগিত ঘোষণা করে, তখনই একটা বার্তা দেয়া হয়েছিল । জিএসপি স্থগিত হওয়ার পাঁচ মাসের মাথায় বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) স্বাক্ষর করে। যেহেতু জিএসপির আওতায় বাংলাদেশের মোট রপ্তানির মাত্র এক শতাংশ পণ্য রপ্তানি হতো শুল্ক ছাড় সুবিধা নিয়ে, সেহেতু বিষয়টিকে আর তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তবে ক্রমশ এটা স্পষ্ট হয় যে জিএসপি সুবিধা আর ফেরত পাওয়া যাবে না। আবার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বহুপক্ষীয় বাণিজ্য সমঝোতার আওতাতেও যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত দূরে থাক, শুল্কছাড় সুবিধা মিলবে না তৈরি পোশাকসহ প্রধান রপ্তানি পণ্যগুলোয়, সেটাও পরিষ্কার হয়ে যায়।

এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিপক্ষীয় এফটিএ করার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার বিষয়ে একটা কথাবার্তা শুরু হয়। সেটাও বেশিদূর এগোয়নি দুটি কারণে। প্রথমত, বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় এফটিএ করার অভিজ্ঞতা না থাকা, দ্বিতীয়ত, তৎকালীন হাসিনা সরকারে সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব বাড়তে থাকা। বাংলাদেশের তৎকালীন নীতি-নির্ধারকরা স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি)-র কাতার থেকে উত্তরণের বিষয়ে যতখানি সক্রিয়তা দেখিয়েছিলেন, তার কিছুটাও যদি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য-সম্পর্ক নিয়ে দেখাতেন, তাহলে আজকে ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক নিয়ে দরকষাকষির কাজ কিছুটা সহজ হতো। একেবারে নাকে-মুখে নানা ধরনের ছাড় দিয়ে প্রধানত তৈরি পোশাকের রপ্তানির বৃহত্তর বাজার ধরে রাখাই মুখ্য হয়ে উঠতো না।

২০ শতাংশ শুল্কই যে বজায় থাকবে, নিশ্চয়তা কী?

এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ট্রাম্প যে বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্কই বজায় রাখবেন,তারই বা নিশ্চয়তা কী? বাংলাদেশের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি হওয়ার আগে তিনি যদি পাল্টা শুল্ক হার যে কোনো অজুহাতে বা কোনো কারণ ছাড়াই বাড়াতে চান, তাহলে কী হবে? কিংবা চুক্তি হওয়ার কিছুদিনের মাথায় যদি শুল্ক বাড়িয়ে দেন, বাংলাদেশ তাহলে কী করবে? এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর কারো জানা নেই। কারণ, ফাইনান্সিয়াল টাইমসের প্রধান অর্থনৈতিক ভাষ্যকার মার্টিন উলফ দু’সপ্তাহ আগে এক লেখায় বলেছিলেন, “একজন যুক্তিবুদ্ধিহীন মানুষ সম্পর্কে কোনোকিছুই আগাম ধারণা করা সম্ভব নয়।”

যেন উলফের এই কথার প্রমাণ দিতেই মঙ্গলবার ট্রাম্প হুমকি দিয়েছিলেন যে, ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ হারে ধার্যকৃত পাল্টা শুল্ক আরো বাড়াবেন, যদি না ভারত রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করে। ঠিকই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই হার দ্বিগুণ করে ৫০ শতাংশ পুনঃনির্ধারণ করেছেন। এর ফলে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। তবে ভারতের ওপর শুল্ক দ্বিগুণ হওয়ায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রতিযোগিতায় বেশ খানিকটা সুবিধাজনক পর্যায়ে চলে গেল। আর তাই আপাতত বেশ স্বস্তিই মিলছে।

[আসজাদুল কিবরিয়া ঢাকাভিত্তিক দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের পরিকল্পনা সম্পাদক। মতামত নিজস্ব]

 

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *