Google Alert – পার্বত্য অঞ্চল
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইস্যুটি নানা কারণেই দেশের জাতীয় ইস্যুগুলোর অন্যতম। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক নানা ফোরামে ‘আদিবাসী দিবস’ তথা বিশ্বের ক্ষুদ্র জাতিগুলোর অধিকারের বিষয়টি এখন ব্যাপক আলোচিত। দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের অধিকার নিয়ে যথেষ্ট সোচ্চার। এমনকি এ ইস্যুটি সম্পর্কে এখন মূল স্রোতের অনেক সচেতন মানুষও অবগত। কিন্তু এত কিছুর পরও বলা যায়, দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ এখনো নানা বৈষম্যের শিকার।
এদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোকে খুব সাধারণভাবে আমরা দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি। এর একটি পাহাড়, তথা পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিগুলো এবং অন্যটি বাকি ৬১ জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র জাতিগুলো। জনসংখ্যা ও জাতির দিক থেকে সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সংখ্যায় বেশি। কিন্তু অধিকার আদায়ের দিক থেকে এসব মানুষ পাহাড়ের তুলনায় পিছিয়ে আছে। শুধু অধিকারের প্রশ্নে নয়, পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নানা দিক থেকে রয়েছে পার্থক্য। নেতৃত্ব, রাজনৈতিক সচেতনতা, ভৌগোলিক অবস্থান, বঞ্চনার মাত্রা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট-এসব পার্থক্য এ দুই অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ভিন্নতা তৈরি করেছে। ফলে যৌক্তিক কারণে তাদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার মধ্যেও রয়েছে বিস্তর ফারাক। স্বয়ং রাষ্ট্র কর্তৃক এ বৈষম্য কেবল দৃষ্টিকটু নয়, বরং অযৌক্তিক।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ ভূমি ও বনের ওপর অধিকার, চাকরি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি-এসব ক্ষেত্রে বঞ্চিত যুগের পর যুগ। পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কিছুটা যুক্ত হলেও সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর জন্য এখনো তেমন কিছু করা হয়নি। রাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে এ বৈষম্য জিইয়ে রেখেছে। আমাদের সংবিধান বলছে, রাষ্ট্র তার জনগণের প্রতি কোনোরকম বৈষম্য তৈরি করবে না, করতে পারে না। অথচ দেশের পরতে পরতে রয়েছে এমন বৈষম্য ও অন্যায়। রাষ্ট্রের এমন বৈষম্য সংবিধান পরিপন্থি ও অন্যায্য।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তরুণদের মধ্যে অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি আশাব্যঞ্জক। তবে সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা আরও বহুগুণ বাড়াতে হবে। অবশ্য এজন্য রাষ্ট্রীয় অনুকূল পরিবেশ দরকার। ক্ষুদ্র জাতিগুলোর প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক হতে হবে। তারা যতই চেষ্টা করুক, রাষ্ট্র তাদের বিপরীতে থাকলে কখনোই তারা নিজেদের অধিকার ও সক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারবে না। একইসঙ্গে এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে পিছিয়ে রেখে রাষ্ট্র তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। কারণ পেছনে যাকে রাখা হয়, সে কেবল পেছনেই টানে! এরপরও যা অধিক গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, অধিকার আদায়ে নিজেদের আরও সোচ্চার করা। এটা সবার জানা যে, অধিকার কেউ কাউকে এমনি এমনি দিয়ে দেয় না, আদায় করে নিতে হয়। সেই কাজটি করতে হবে পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত হয়ে। সবাই মিলে একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব।
যে জাতি ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে নিজের ভাষার জন্য সংগ্রাম করে জীবন দিয়েছে, সেই জাতি এখন পর্যন্ত দেশের অপরাপর জনগোষ্ঠীর ভাষার সাংবিধানিক মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর ওপর নিপীড়ন ও বৈষম্যের আজও অবসান হয়নি। গত ৫৪ বছর ধরে রাষ্ট্র যে ভুল করে এসেছে, তা শোধরানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। বৈষম্য দূর করার যে মূলমন্ত্র নিয়ে গত জুলাই গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, সেই নতুন বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পারে তার ঐতিহাসিক দায় থেকে নিজেকে মুক্ত করতে।
গত জুলাই-আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ একটি নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি করেছে। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ছাত্র-জনতা নিজেদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে অপার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ছাত্রসমাজ, যুবসমাজ, সংগঠন, সর্বোপরি সাধারণ মানুষকে একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সুযোগ ও সম্ভাবনা বারবার আসে না। সমগ্র বাংলাদেশের জন্য যেমন একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে, তেমনি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর জন্যও। এখনই উত্তম সময় নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করার। পাহাড় ও সমতলের ছাত্রসমাজ এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।
তাই আসুন, সবাই মিলে নিজেদের অধিকার বুঝে নেই। রাষ্ট্রটি আমাদের, তাই নিজেদের অধিকার নিজেদের নিশ্চিত করতে হবে। অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দোষ দেওয়া সমাধান নয়, বরং সহযোগিতা সমাধানের উপায় হতে পারে। এ সরকারের মূল কাজ রাষ্ট্রের সংস্কার করা। কাজটি সহজ নয়। আমরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ রাষ্ট্র সংস্কারের এ মহৎ কাজে যুক্ত থাকতে চাই। আমাদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলমান সব বৈষম্যের অবসান চাই। সংবিধানে আমাদের স্বীকৃতি চাই। আত্মপরিচয়ের সংকটের অবসান চাই। সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগুলোর জন্য মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন আইন তৈরির কাজ শুরু হোক। পাহাড়ের বন্ধুদের দীর্ঘ লড়াইয়ের ফসল পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন চাই। সর্বোপরি, আমরা দেশের সম্পদ হয়ে অবদান রাখতে চাই। যে সুযোগ ছাত্র-জনতা আত্মত্যাগের বিনিময়ে তৈরি করেছে, আমরা যেন সেই সুযোগ অবহেলায় হাতছাড়া না করি। রাষ্ট্র হয়ে উঠুক সব জাতির জনগণের। কারণ, দায় যার, মেটানোর দায়িত্বও তারই।
রিপন বানাই : মানবাধিকার কর্মী; সদস্য সচিব, সমতল আদিবাসী অধিকার আন্দোলন
riponbanai@ymail.com