Google Alert – সশস্ত্র
ছবির উৎস, Getty Images
গাজা সিটি দখলের জন্য ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে দেশটির নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি। মন্ত্রিসভা যুদ্ধ শেষ করার জন্য পাঁচটি নীতিও গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে হামাস বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ নয় এমন একটি বিকল্প বেসামরিক সরকার গঠন করা।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জানিয়েছে, সেনাবাহিনী গাজা সিটির নিয়ন্ত্রণ নেবে যেখানে লাখো ফিলিস্তিনি বাস করেন।
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর এই পদক্ষেপ ইসরায়েলেও বিরোধিতার মুখে পড়েছে। হামাসের হাতে জিম্মিদের পরিবারগুলোও বলছে, এর ফলে জিম্মিদের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে।
আরও বেশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
পরিকল্পনাটি অনুমোদিত হওয়ার আগে দেশটির সামরিক নেতৃত্ব ও বিরোধী দলও সতর্কতা উচ্চারণ করে বলছিল, গাজার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষোভের মধ্যে এই পদক্ষেপ ইসরায়েলকে আরও বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকিতেও ফেলবে।
নেতানিয়াহুর কার্যালয় গাজা শহর দখলের অনুমোদিত পরিকল্পনা এবং “যুদ্ধ শেষ করার জন্য পাঁচটি নীতি” সম্পর্কে বিস্তারিত একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে, যা মন্ত্রিসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে গৃহীত হয়েছে।
“যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে বেসামরিক জনগণকে মানবিক সহায়তা প্রদানের সময় আইডিএফ গাজা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেবে,” এতে বলা হয়েছে।
“যুদ্ধ শেষ করার” জন্য যে নীতিগুলো নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে আছে––
১. হামাসের নিরস্ত্রীকরণ।
২. জীবিত ও মৃত উভয় ধরনের জিম্মিকে ফেরানো।
৩. গাজা উপত্যকার নিরস্ত্রীকরণ।
৪. গাজা উপত্যকার ওপর ইসরায়েলি নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ।
৫. হামাস বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ নয় এমন একটি বিকল্প বেসামরিক সরকার গঠন।
“মন্ত্রিসভার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা বিশ্বাস করেছিলেন যে মন্ত্রিসভার কাছে উপস্থাপিত বিকল্প পরিকল্পনা হামাসের পরাজয় বা অপহৃতদের ফিরিয়ে আনতে পারবে না,” বিবৃতির উপসংহারে বলা হয়েছে।
ছবির উৎস, Anadolu via Getty Images
গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান সম্প্রসারণের বিষয়ে নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা নিয়ে এর আগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন জাতিসংঘের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
“এটি লাখ লাখ ফিলিস্তিনির জন্য বিপর্যয়কর পরিণতির ঝুঁকি তৈরি করবে এবং গাজার অবশিষ্ট জিম্মিদের জীবনকে আরও বিপন্ন করতে পারে,” মঙ্গলবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক সভায় বলেছিলেন সহকারী মহাসচিব মিরোস্লাভ জেনকা।
ইসরায়েল ইতোমধ্যেই গাজা উপত্যকার বিশাল অংশের ওপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ রাখার দাবি করে আসছে। জাতিসংঘের অনুমান, গাজার ৮৭ শতাংশ এলাকাই হয় স্বীকৃত সামরিক নিয়ন্ত্রণে অথবা উচ্ছেদের নোটিশের আওতায় আছে।
গত মার্চ মাসে যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর ইসরায়েল পুরো উপত্যকাকে “বিপজ্জনক যুদ্ধক্ষেত্র” ঘোষণা করে যা পরবর্তী মাসগুলিতে ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়েছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী বা আইডিএফ পর্যায়ক্রমে নির্দিষ্ট কিছু এলাকার জন্য উচ্ছেদের নোটিশও জারি করে, যদিও কখন এগুলো প্রত্যাহার করা হয় তা সবসময় স্পষ্ট করা হয় না।
ছবির উৎস, Reuters
নিজের প্রস্তাবগুলো নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকের প্রস্তুতি নেওয়ার সময়, ফক্স নিউজকে একটি সাক্ষাৎকার দেন নেতানিয়াহু। যেখানে বিস্তারিত কিছু না বললেও ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গাজার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।
এছাড়া হামাসকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে বেসামরিক শাসন অন্য দলের কাছে হস্তান্তর করতে চান বলেও জানান তিনি।
তবে তিনি এটাও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এই অঞ্চলটি ধরে রাখার ইচ্ছা নেই তার।
নেতানিয়াহু বলেছেন, “আমরা এটি পরিচালনা করতে চাই না। আমরা সেখানে একটি শাসকগোষ্ঠী হিসেবে থাকতে চাই না। আমরা এটি আরব বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করতে চাই।”
কী ব্যবস্থাপনা করা হবে বা কোন দেশগুলো এখানে জড়িত থাকতে পারে সে সম্পর্কে অবশ্য বিস্তারিত কিছু বলেননি নেতানিয়াহু। তবুও, যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার জন্য তিনি কী কল্পনা করছেন এটি তারই একটি ইঙ্গিত।
আপাতত নেতানিয়াহু একটি বিস্তৃত আক্রমণ চালাতে চান যার মাধ্যমে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজা উপত্যকার কেন্দ্রীয় অংশের শিবিরগুলোতে অভিযান চালাতে পারে যেখানে প্রায় দশ লাখের মতো ফিলিস্তিনি বসবাস করে
বর্তমানে গাজার প্রায় ৭৫ শতাংশ ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে বলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করে।
সম্ভাব্য এই অভিযান যা কয়েক মাস ধরে চলতে পারে, এর অর্থ হবে ব্যাপকভাবে মানুষের বাস্তুচ্যুতি। এছাড়া এর মাধ্যমে সেখানে মানবিক পরিস্থিতি আরও খারাপ দিকে যাওয়ারও শঙ্কা রয়েছে।
এই পদক্ষেপের মাধ্যমে গাজার পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশকারী দেশগুলোর কাছে ইসরায়েলকে নতুন করে সমালোচিত করতে পারে।
ছবির উৎস, Bloomberg via Getty Images
ইসরায়েলি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা নিয়ে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে উদ্বেগ দেখা যায়।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াল জামির নেতানিয়াহুকে এক বৈঠকে বলেন যে গাজার সম্পূর্ণ দখল সেনাদের জন্য “ফাঁদে পা দেওয়ার সমান”।
ইসরায়েলের সেনাপ্রধান তার দেশের সরকারকে সতর্ক করেছেন বলেও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, এই আক্রমণ হামাসের কাছে এখনো জিম্মি ২০ জন, যাদেরকে জীবিত বলে মনে করা হচ্ছে, তাদের জীবনকে আরও বিপন্ন করে তুলবে।
অনেক জিম্মি পরিবারও এই পরিকল্পনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় হলো হামাসের সাথে আলোচনা।
মারিভ সংবাদপত্রের মতে, “প্রচলিত মূল্যায়ন হলো বেশিরভাগ এবং সম্ভবত জীবিত জিম্মিরা মৃত্যুবরণ করবে”। হয় জিম্মিকারীরা তাদের তাদের হত্যা করবে অথবা দুর্ঘটনাক্রমে ইসরায়েলি সৈন্যদের দ্বারা তাদের মৃত্যু হবে।
নতুন করে বিস্তৃত আক্রমণের এই পরিকল্পনা ইসরায়েলের কিছু বন্ধু দেশের মধ্যেও মতপার্থক্য তৈরি করেছে।
ইসরায়েলে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত সাইমন ওয়াল্টার বলেছেন, গাজার পূর্ণ দখল একটি “বিশাল ভুল” হবে।
একই সাথে যুক্তরাজ্য কর্তৃক ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি হামাসের জন্য একটি পুরস্কার হবে–– যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের এমন অভিযোগও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
গাজা দখল না করতে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং। তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, “অস্ট্রেলিয়া ইসরায়েলকে এই পথে না যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে যা গাজায় মানবিক বিপর্যয়কে আরও খারাপ করবে।”
“একটি স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করার একমাত্র পথ হল দুই-রাষ্ট্রীয় সমাধান – একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র এবং ইসরায়েল রাষ্ট্র যারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমান্তের মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তায় পাশাপাশি বসবাস করবে,” তিনি যোগ করেন।
ছবির উৎস, Reuters
এদিকে, ইসরায়েলের একজন কট্টর সমর্থক হিসেবে পরিচিত, মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি, যুক্তরাষ্ট্রে বিবিসির সংবাদ অংশীদার সিবিএস নিউজকে বলেছেন, উপত্যকা সম্পূর্ণরূপে দখল করা হবে কি না তা ইসরায়েলি সরকারের সিদ্ধান্ত। “তাদের কী করা উচিত বা কী করা উচিত নয় তা বলা আমাদের কাজ নয়।”
নেতানিয়াহু এখন পর্যন্ত যুদ্ধের পর গাজার জন্য কোনো পরিকল্পনা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। কেবল ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বা হামাসের বাইরে তৃতীয় কোনো পক্ষের শাসকের কথা বলছেন তিনি।
জরিপে দেখা গেছে, ইসরায়েলি জনগণের বেশিরভাগই জিম্মিদের মুক্তি এবং যুদ্ধের সমাপ্তির জন্য হামাসের সাথে একটি চুক্তির পক্ষে।
হামাস আপাতত আলোচনায় আগ্রহী নয় বলেই মনে করেন ইসরায়েলি নেতারা। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ইসরায়েলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপের ফলে হামাসও এখন সাহস পাচ্ছে।
এছাড়া পূর্ণ দখলের হুমকি, দুই পক্ষের মধ্যে থেকে থাকা আলোচনায় ছাড় দিতে বাধ্য করারও কৌশলের অংশ হতে পারে বলে মনে করেন তারা।
কিন্তু এখানে অনেকেই বিশ্বাস করেন যে নেতানিয়াহু তার জোটের টিকে থাকার নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য সংঘাত দীর্ঘায়িত করছেন, যারা অতি-জাতীয়তাবাদী মন্ত্রীদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে এবং হামাসের সাথে কোনো চুক্তি হলে সরকার ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
হামাস পরিচালিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধে ৬১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন।
সাতই অক্টোবর ইসরায়েলের ওপর হামাসের হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হয়, এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের মধ্যে প্রায় ৫০ জন এখনো বেঁচে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।