Google Alert – পার্বত্য চট্টগ্রাম
বিশ্বব্যাপী আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম ও যোগাযোগের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৯ আগস্টকে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রতিবছর এ দিনটি সারা বিশ্বে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়েই পালন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বসবাসকারী অর্ধশতাধিক ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর জনগণও দিবসটি উদযাপন করে থাকেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এক ভিন্নধর্মী ও গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসাবে আদিবাসীদের জীবন, সংস্কৃতি ও সংগ্রামকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে একাধিক সিনেমা। এসব সিনেমা শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পরিচয়, ভাষা, ভূমি, অধিকার ও নিঃশব্দ বঞ্চনার ইতিহাসকে তুলে ধরার একটি সাহসী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এগুলো নির্মাণে যুক্ত হয়েছেন কিছু চিন্তাশীল নির্মাতা ও আদিবাসী শিল্পী, যারা বহুদিন ধরেই মূলধারার বাইরে থেকেও নিজেদের গল্প বলতে চেয়েছেন। বিশ্ব আদিবাসী দিবস তাই শুধু একটি প্রতীকী উদযাপন নয়, বরং সিনেমার ভাষায় আদিবাসীদের আত্মপ্রকাশের একটি দৃশ্যমান আলোকস্তম্ভ হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, খিয়াং, মুরং, বম, পাংখো, লুসাই, রাখাইন, খাসিয়া, মণিপুরী, সাঁওতাল, ওঁরাও, মাহালি, গারো, হাজংসহ আরও অনেক ভাষার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস রয়েছে। এর মধ্যে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় বাস করে ১১টি নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ। প্রত্যেকের রয়েছে আলাদা ভাষা ও সংস্কৃতি। কিন্তু এসব ভাষায় সিনেমা নির্মাণের ইতিহাস খুব কম। হাতেগোনা কিছু সিনেমা নির্মাণ হলেও তা রয়েছে আড়ালে। খুব বেশি প্রসারিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না।
ম্রো ভাষায় নির্মিত সিনেমা ‘ক্লোবং ম্লা’। এটিই দেশে নির্মিত প্রথম ম্রো ভাষার সিনেমা। এর বাংলা নাম ‘গিরিকুসুম’। নির্মাণ করেছেন প্রদীপ ঘোষ। সিনেমাটির কাহিনি লিখেছেন ম্রো ভাষার লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো। এর গল্প আবর্তিত হয়েছে ক্লোবং নামের এক কন্যাশিশুকে কেন্দ্র করে। শৈশবে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ক্লোবংয়ের মা-বাবা। একমাত্র বড় ভাই ক্লোবংকে আদর-স্নেহে বড় করে তোলে। ভাইটি জুম কাজে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকত আর ক্লোবং ঘরের যাবতীয় কাজ করত। এক সময় তার ভাই বিয়ে করে। কিন্তু আদর-স্নেহ দূরে থাক, ক্লোবংকে অত্যাচার করতে থাকে তার বৌদি। প্রিয় বোনের প্রতি এমন অত্যাচার মেনে নিতে পারেনি বড় ভাই। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে সমাপ্তির দিকে যায় কাহিনি। সিনেমাটিতে মূলত ম্রোদের পারিবারিক জীবন ও সংগ্রাম চিত্রায়িত হয়েছে। এটি বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে এবং বেশ প্রশংসিতও হয়।
এ ছাড়া নির্মাতা প্রদীপ ঘোষ নির্মাণ করেছেন আরও একাধিক সিনেমা। মারমা ভাষায় নির্মিত প্রথম সিনেমা ‘গিরিকন্যা’। এটিও নির্মাণ করেছেন তিনি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও এটি প্রদর্শিত হয়েছে। বান্দরবান পার্বত্য জেলার মারমা জনগোষ্ঠীর একজন প্রবীণ চিকিৎসক ডা. মং উষা থোয়াইয়ের গল্প অবলম্বনে এবং প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছে এটি। এতে মারমা জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার পাশাপাশি বনদস্যুদের হাত থেকে পরিবেশ রক্ষার কথাও উঠে এসেছে। নির্মাতা বলেন, ‘মারমা জনগোষ্ঠীর প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে মারমা ভাষায় সিনেমাটি নির্মাণ করেছি।’ এ ছাড়া প্রদীপ ঘোষ নির্মাণ করেছেন বম ও খেয়াং ভাষায় দুটি শর্টফিল্ম। খেয়াং ভাষার প্রথম শর্টফিল্মের নাম ‘খেতসু’। এর বাংলা নাম ‘প্রেয়সী’। বম ভাষার প্রথম শর্টফিল্ম ‘মুনখাত দুত হেন’। এর বাংলা নাম ‘বন্ধন’। সিনেমাগুলো নিয়ে এ সাক্ষাৎকারে নির্মাতা বলেন, ‘আমাদের দেশে যেসব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী আছে তাদের মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতেই আমাদের এ কর্মপ্রয়াস। আমাদের ভূখণ্ডে যেসব ভাষার অস্তিত্ব আছে সেসব মানুষের মাতৃভাষাকে সম্মান জানানোর জন্যই আমরা সিনেমাগুলো নির্মাণ করেছি।’
দেশের ইতিহাসে চাকমা ভাষায় নির্মিত প্রথম সিনেমা ‘মর থেংগারি’ বা ‘মাই বাইসাইকেল’। এটি নির্মাণ করেছেন অং রাখাইন। বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়ে প্রশংসা কুড়ায় এটি। নির্মাতা জানান, সিনেমাটি নির্মিত হয় ২০০২ সালে। কিন্তু অসম্পন্ন কিছু কাজ সম্পন্ন করে এর প্রথম প্রদর্শনী হয় ২০১৪ সালের ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিপেন্ডেন্ট শর্ট ফিল্ম ফ্যাস্টিভ্যালে। আদিবাসী মানুষের জীবন ও তাদের যাপনের নানা সংগ্রামচিত্র এতে ফুটে উঠেছে। শহরে টিকতে না পেরে আবার পাহাড়ের কোলে গ্রামে ফিরে আসে এক প্রান্তিক মানুষ কমল, সঙ্গে একমাত্র সম্বল একটি সাইকেল। কমলের ছোট ছেলেটা বাবা আর সাইকেলে উল্লসিত হয়ে উঠলেও, স্ত্রী তার এই খালি হাতে বাড়ি ফেরা মোটেও ভালোভাবে নিতে পারে না। কমল ঠিক করে সে আর শহরে যাবে না। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকার পাহাড়ে কাজ কোথায়। যেখানে মাটি ছিল সেখানে এখন পানি। এইখানে থাকলে অন্যদের মতো বসে বসে মদ খাওয়া আর গ্যাঞ্জাম হল্লা করা ছাড়া কাজ খুবই কম। কিন্তু কোণঠাসা মানুষই উত্তরণের উপায় খুঁজে নেয়। সে বুদ্ধি করে তার সাইকেল নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা শুরু করে। মানুষদের তার সাইকেলে এগিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিতে থাকে যাকে পায় তাকেই। প্রথমে তো কেউ সাইকেলে উঠতেই চায় না। দেশের এ কোণায় কস্মিনকালেও কেউ কখনো সাইকেল দেখেছে? ধীরে ধীরে একজন একজন করে তার সাইকেলে উঠতে থাকে, কমলও তাদের বাজারে কি বাড়িতে এগিয়ে দেয়। কিন্তু কমল কারো কাছে কিছু চাইতে পারে না; কেউ কেউ টাকা দেয়, কেউ কেউ আবার দেয় না। এমনই গল্পে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি। বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটি প্রদর্শিত হলেও, সেন্সর ছাড়পত্র না পাওয়ায় এর বাণিজ্যিক মুক্তি সম্ভব হয়নি এখনো। এদিকে নির্মাতা অং রাখাইন ম্রো জনগোষ্ঠীকে নিয়ে ‘ম্রো’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ শুরু করেন। কয়েক বছর আগে থেকেই এর কাজ শুরু করলেও নানা জটিলতায় এখনো সম্পন্ন করতে পারেননি। সিনেমাটি নিয়ে অং বলেন, ‘এখনো সিনেমার কাজ সম্পন্ন করতে পারিনি। কিছু জটিলতা আছে। তবে এটুকু বলতে পারি, এটি ২০২৬ সাল নাগাদ মুক্তি দেব।’
চাকমা ভাষার নির্মিত হয়েছে শর্টফিল্ম ‘পোড়া কবাল্লে’। এর বাংলা নাম হলো ‘পোড়া কপাল’। এটি নির্মাণ করেছেন সুপ্রিয় চাকমা (শুভ)। বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শনের পাশাপাশি এটি ইউটিউব চ্যানেলেও অবমুক্ত করা হয়েছে। সিনেমা প্রসঙ্গে নির্মাতা জানান, এতে মদ (মাদক) ও চাকরি দুটি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। মদ পান করে সংসারে ঝামেলা সৃষ্টি করেন নায়কের বাবা এলিন চাকমা। পরে এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে নায়কের মা আত্মহত্যা করেন। বাড়ি ছেড়ে চলে যান নায়ক। অনেক প্রতিকূলতার মাঝে বড় হয়ে চাকরি না হওয়ার কারণে প্রেমিকাকে হারান নায়ক সুমন চাকমা। মাদক আর চাকরি বর্তমান সময়ে বিভিন্ন প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে। আর এসব বিষয় সিনেমায় তুলে ধরা হয়েছে চাকমা ভাষার মাধ্যমে।
এ ছাড়া চাকমা ভাষায় নির্মিত হয়েছে শর্টফিল্ম ‘ডুলু কুমুরি’, হাজংদের জীবন-সংগ্রাম নিয়ে নির্মিত হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র, মধুপুরের মান্দি আদিবাসীদের নিয়ে নির্মিত হয়েছে সিনেমা ‘আইয়াও’ ইত্যাদি। বাংলাদেশে আদিবাসীদের নিয়ে নির্মিত সিনেমার সংখ্যা কম হলেও বিষয়গত গুরুত্ব, ভাষাগত বৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিত্বের কারণে এগুলোর তাৎপর্য অনেক বেশি। এ ধরনের সিনেমা শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং আদিবাসী জনগণের স্বর ও পরিচয় তুলে ধরার এক অনন্য মাধ্যম।