Google Alert – সশস্ত্র
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পাশের শহর গাজীপুরে এক দিনের ব্যবধানে দুই সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনা আলোচনা তৈরি করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, আবার গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তরা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করেছে দৈনিক প্রতিদিনের কাগজের স্টাফ রিপোর্টার মো. আসাদুজ্জামান তুহিনকে।
পৃথক ঘটনায় এর আগের দিন বুধবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে নগরীর সাহাপাড়া এলাকায় বেধড়ক মারধরের শিকার হয়েছেন আরেক সাংবাদিক।
অভিযোগ উঠেছে, অটোরিকশা চালকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের ভিডিও ধারণ করতে গিয়ে হামলার শিকার হন দৈনিক বাংলাদেশের আলো পত্রিকার রিপোর্টার আনোয়ার হোসেন। গুরুতর আহত অবস্থায় তিনি এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
দুটি ঘটনার পেছনে চাঁদাবাজি বা সংঘবদ্ধ ছিনতাইয়ের অভিযোগ তুলেছেন অনেকে। আবার কারো কারো দাবি এগুলো পরিকল্পিত হামলা।
ভিডিও ধারণ করতে গিয়েই সাংবাদিক তুহিন হামলার শিকার হয়েছেন বলে দাবি পুলিশের। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের শনাক্ত করা হয়েছে বলেও তারা জানিয়েছে।
পুলিশ বলছে, এগুলো পরিকল্পিত ঘটনা কিনা সে বিষয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এদিকে, তুহিন হত্যার ঘটনায় গাজীপুরের বাসন থানায় অজ্ঞাতনামা ২৫ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন তার ভাই মোহাম্মদ সেলিম। আর আনোয়ার হোসেনের ওপর হামলার ঘটনায় একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
একদিনের ব্যবধানে এমন ঘটনায় স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন, নগরীতে এমন ঘটনায় আতঙ্কিত তারা।
হামলার ঘটনা ঘিরে কৌতুহল
গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ঈদগাঁ মার্কেটের নিচতলায় দুর্বত্তরা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করেছে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে দিকে এই ঘটনার পরই একটি ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যমে।
যেখানে দেখা যাচ্ছে, ঈদগাঁ মার্কেটের নিচতলায় একটি কাপড়ের দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পেছন থেকে একজন নারীকে ধাক্কা দেয় এক ব্যক্তি।
তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে পেছন থেকে অস্ত্র নিয়ে ওই ব্যক্তির ওপর হামলা চালায় কয়েকজন যুবক। হামলাকারীদের হাত থেকে বাঁচতে দৌড়ে পালায় ওই ব্যক্তি।
এরপর ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে চারদিকে কাউকে খুঁজতে দেখা যায় ওই অস্ত্রধারী যুবকদের। কিছুক্ষণ পর তারাও ক্যামেরার বাইরে চলে যায়। ভিড় করে উৎসুক জনতা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাশেই দাঁড়িয়ে এই ঘটনার ভিডিও ধারণ করছিলেন সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন। ভিডিও করতে দেখে তার ওপর হামলা চালায় ওই অস্ত্রধারী যুবকেরা। এসময় তাদের হাত থেকে বাঁচতে মার্কেটের নিচের একটি চায়ের দোকানে আশ্রয় নিলেও শেষ রক্ষা হয়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, চায়ের দোকানে গিয়ে তুহিনের ওপর হামলা চালানো হয়। শুরুতে মারধর করে ভিডিও ডিলিট করতে বললেও পরে তাকে এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করে তারা। এসময় ওই চায়ের দোকানি তাদেরকে থামানোর চেষ্টা করলেও কাজ হয়নি।
সিসিটিভি ফুটেজের ভিডিও যাচাই করেছে পুলিশ। প্রাথমিক তদন্ত শেষে তারা বলছে, এই পুরো ঘটনা নিজের মোবাইলে ধারণ করেছিলেন সাংবাদিক তুহিন। ভিডিও করতে দেখেই সশস্ত্র হামলাকারীরা তার ওপর চড়াও হয়।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার মো. রবিউল ইসলাম বলছেন, “এখানে একটি নারীঘটিত বিষয়কে কেন্দ্র করেই প্রথমে একটি আহতের ঘটনা এবং পরবর্তীতে একটি কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে আমাদের প্রাথমিক তদন্তে অন্য কিছু উঠে আসেনি।”
সিসিটিভি ফুটেজে থাকা ওই নারীকেও খুঁজছে পুলিশ। হামলাকারীদের সঙ্গে ওই নারীর কোনো যোগসূত্র আছে কি না সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আসাদুজ্জামান তুহিনের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে তার পরিবারে।
গাজীপুরে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেলে মরদেহ নিতে আসা তুহিনের বড়ভাই মোহাম্মদ সেলিম মিয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রাত নয়টায় শুনছি, আমার ভাইয়ের লাশটা এখন মর্গে পড়ে আছে।”
তার ভাইয়ের হত্যার বিচার চান মি. সেলিম।
এদিকে, পৃথক ঘটনায় দুর্বৃত্তদের বেধড়ক মারধরের শিকার হয়েছেন আনোয়ার হোসেন নামে গাজীপুরের আরেক সাংবাদিক। গুরুতর আহত অবস্থায় তিনি এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
বুধবারের ওই ঘটনার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। যেখানে দেখা গেছে, অন্তত আট জন ব্যক্তি ওই সংবাদকর্মীকে বেধড়ক পেটাচ্ছে। এমনকি মারধরের এক পর্যায়ে ইট দিয়ে আঘাতও করা হয় তাকে।
পাশেই পুলিশ সদস্যদের দেখা গেলেও তাৎক্ষণিকভাবে তারা এগিয়ে আসেনি। কিছুক্ষণ পর রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করতে দেখা যায়।
এই ঘটনায় আহত সাংবাদিকের মা আনোয়ারা সুলতানা গাজীপুরের সদর মেট্রো থানায় মামলা দায়েরের পর শুক্রবার একজনকে আটক করে পুলিশ।
হামলার ঘটনায় ক্ষোভ-আতঙ্ক
গাজীপুরে একদিনের ব্যবধানে দুই সাংবাদিকের ওপর হামলার এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় সাধারণ মানুষ ও সংবাদকর্মীরা। একইসাথে তাদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। নগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও উঠেছে নানা প্রশ্ন।
স্থানীয়দের অনেকে বলছেন, চান্দনাসহ নগরীর বেশ কয়েকটি জায়গা অপরাধীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। নিয়মিত ছিনতাই-চাঁদাবাজির ঘটনাও ঘটছে।
পুলিশ এ ব্যাপারে উদাসীন বলেও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ।
স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন, গাজীপুরের চান্দনা এলাকার যেখানে সাংবাদিক তুহিনকে হত্যা করা হয়েছে ওই এলাকায় অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গাজীপুরের একজন সাংবাদিক দাবি করেন, “শিল্প এলাকা হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানের মানুষ এখানে এসে কাজ করে। সেই সুযোগে কিছু মানুষ অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়েছে, যাদেরকে ব্যবহার করে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি।”
“চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। সরকার পতনের পর এই এলাকায় অপরাধীদের বস পাল্টাইছে, শান্তি নাই ভাই,” বলছিলেন চান্দনা এলাকার একজন বাসিন্দা।
সাংবাদিকদের ওপর এমন হামলার ঘটনায় আতঙ্কিত গাজীপুরের স্থানীয় অনেক সংবাদকর্মী। তুহিন হত্যার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
“রাস্তায় ফেলে পুলিশের সামনে সন্ত্রাসীরা মানুষকে বেধড়ক পেটাচ্ছে, চান্দাবাজি করতেছে। পুলিশ কিছু বলে না। আমাদের নিরাপত্তা কোথায়,” বিবিসি বাংলাকে বলেন স্থানীয় সাংবাদিক শফিউদ্দিন জিন্নাহ।
তিনি বলেন, “শুধু গাজীপুরের সাংবাদিক না পুরো সাংবাদিক সমাজ এই ঘটনায় আতঙ্কিত। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।”
গাজীপুরের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম বলছেন, “প্রকাশ্য দিবালোকে এভাবে হত্যার ঘটনা মানুষের মধ্যে ভয় তৈরি করেছে।”
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেশ কিছু ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে কিনা এ নিয়েও সন্দেহ আছে আমার।”
অবশ্য পুলিশের দাবি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছে তারা। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ কমিশনার রবিউল ইসলাম জানান, সাংবাদিক তুহিন হত্যাকাণ্ডে আসামি গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
সিসিটিভি দেখে চারজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজে থাকা নারীকে পাওয়া গেলে হত্যার প্রকৃত কারণ জানা যাবে বলেও মনে করেন তিনি।
এছাড়া সাংবাদিক আনোয়ারের ওপর হামলার ঘটনায় প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও জানান মি. ইসলাম।