সাদামাটি আর বৈচিত্র্যময় এক নৈসর্গিক জনপদ

Google Alert – পার্বত্য অঞ্চল

নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুর। আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, সারিবদ্ধ ছোটবড় পাহাড়-টিলা আর নদীর ছড়াবেষ্টিত এক বৈচিত্র্যময় জনপদ। ভারত সীমান্তের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা নেত্রকোনার একটি উপজেলা এটি। ২৭৯ দশমিক ২৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ উপজেলা ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রকৃতি আর সংস্কৃতির সংমিশ্রণে এক অপরূপ লীলাভূমি।

গারো পাহাড়ের স্তরে স্তরে লুকিয়ে আছে নানা রঙের চিনামটি, ঝরনার মতো বয়ে চলা সোমেশ্বরী নদীর জলধারা-সিলিকা বালির চরাচর, সুসং রাজবাড়ি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি, গারো ব্যাপ্টিস্ট কনভেনশন (জিবিসি), কমলা রানির দিঘি, রানিখং মিশন, হাজং মাতা রাশিমণির স্মৃতিসৌধসহ নানা কিংবদন্তিতে সমৃদ্ধ এই জনপদ।

চিনামাটির পাহাড় : দুর্গাপুরের কুল্লাগড়া ইউনিয়নে গারো পাহাড়ের অন্তর্গত একটি টিলাবেষ্টিত এলাকা বিজয়পুর। এর খুব কাছেই ভারতের সীমানায় রয়েছে সুউচ্চ গারো পাহাড়। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর ১৯৫৭ সালে ভেদিকুড়া স্থানে প্রথম এ সাদামাটির সন্ধান পায়। ওই সময়ে এক জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৬০০ মিটার প্রশস্ত এই খনিজ অঞ্চলে প্রায় ২৪ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন সাদামাটি রয়েছে। ১৯৬৮ সাল থেকে মাটি উত্তোলনের কাজ শুরু হয়। এর পর থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো থেকে ইজারা নিয়ে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সাদামাটি আহরণ করে। ২০১৫ সালে পরিবেশবাদী সংগঠন ‘বেলা’ মাটি আহরণের নামে আদিবাসীদের উচ্ছেদ এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করে আদালতে মামলা দায়ের করে। আদালত ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ মাটি তোলার কাজ বন্ধের নির্দেশ দেন।

সাদামাটি এলাকাটি এখন পর্যটন এলাকা হিসাবে পরিচিত। সেখানে কালো, খয়েরি, বেগুনি, নীলসহ আরও কয়েক রঙের মাটির স্তর রয়েছে। বর্তমানে খননকাজ বন্ধ থাকলেও আগে খনন করা এলাকাগুলোয় গেলে নানা রঙের মাটির স্তর সুস্পষ্ট দেখা যায়, যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। আর খনন করা এলাকাগুলো পরিণত হয়েছে নীল পানির লেকে। লেকগুলো অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সুদৃশ্য। প্রতিদিনই সেখানে দূর-দূরান্তের অগণিত পর্যটক ভিড় করেন। ২০২১ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন প্রোডাক্ট বা জিআই পণ্য) হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে এই মাটি।

পাহাড়ি স্রোতঃস্বিনী নদী সোমেশ্বরী : ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বিঞ্চুরীছড়া, বাঙাছড়া প্রভৃতি ঝরনাধারা ও পশ্চিমদিক থেকে রমফা নদীর স্রোতধারা একত্রিত হয়ে সোমেশ্বরী নদীর সৃষ্টি। একসময় নদীটি সিমসাং নামে পরিচিত ছিল। ৬৮৬ বঙ্গাব্দে সোমেশ্বর পাঠক নামে এক সিদ্ধপুরুষ এই অঞ্চল দখল করে নেওয়ার পর থেকে নদীটি সোমেশ্বরী নামে পরিচিতি পায়। সর্পিলাকার নদীটি দুর্গাপর থেকে চৈতালি হাওড় হয়ে জারিয়া, ঝাঞ্জাইল বাজারের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিশেছে কংস নদে। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১১৩ কিলোমিটার। গড় প্রস্থ ১১৪ মিটার। নিরিবিলি পাহাড়ি প্রকৃতির কোলজুড়ে ছুটে সোমেশ্বরীর রয়েছে কাচের মতো পরিষ্কার পানির ঐতিহ্য।

রানিখং মিশন : রানিখং মূলত একটি পাহাড়ি টিলার নাম। এর নামকরণের সঠিক ইতিহাসের উল্লেখ নেই কোথাও। তবে কথিত আছে একসময় এই জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলটিতে ‘খং’ রানি নামে এক রাক্ষসীর বাস ছিল। গারো আদিবাসীরা তাকে পরাস্ত করে সেখানে জনবসতি গড়ে তোলেন। আর তাই এই রাক্ষসীর নাম অনুসারে জায়গাটির নামকরণ করা হয় রানিখং। তবে এ ধারণার পক্ষে কোনো যুক্তিযুক্ত প্রমাণ নেই। নামকরণ যেভাবেই হোক, রানিখং-এর রানি শব্দটি প্রয়োগ যথার্থ ও সার্থক।

কমলা রানির দিঘি: বিরিশিরি ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই কমলা রানির দিঘি। দিঘিটি সোমেশ্বরী নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও এর দক্ষিণ-পশ্চিম পাড় এখনো কালের সাক্ষী হয়ে আছে। জনশ্রুতি রয়েছে, ১৫ শতকের শেষদিকে সুসং দুর্গাপুরের রাজা জানকি নাথ বিয়ে করেন কমলা দেবী নামে এক নারীকে। কমলা যেমনই রূপেগুণে সুন্দরী ছিলেন, তেমনই ছিলেন পরম ধার্মিক। রাজা জানকি নাথও ছিলেন পরম প্রজাহিতৈষী। তাদের পুত্রসন্তান রঘুনাথের জন্ম হলে প্রজাদের কল্যাণে পানির অভাব নিবারণের জন্য একটি পুকুর খনন করা হয়। কিন্তু পুকুরে আর পানি উঠল না। একরাতে রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হন কমলা দেবী যদি পুকুরের মাঝখানে গিয়ে পুজো দেন, তাহলে পানি উঠবে। প্রজাহিতৈষী কমলা পুজোয় বসলে চারদিক দিয়ে পানি উঠতে শুরু করল। কমলা দেবী উঠে দাঁড়ালেন এবং করজোড়ে দেবতার উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। পানি বেড়েই চলল, রাজা জানকি নাথ অস্থির হয়ে রানিকে পাড়ে ভিড়ার জন্য চিৎকার শুরু করলেন। ততক্ষণে পানি রানিকে ডুবিয়ে ফেলল। রানি আর পানি থেকে উঠে এলেন না। রাজা এ দৃশ্য দেখে বিচলিত হয়ে গেলেন। শিশু রঘুনাথ মাতৃদুগ্ধ ছাড়া আর কিছুই খায় না। একরাতে রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হলেন। শিশুসন্তান রঘুকে পুকুরের পাড়ে রেখে এলে রানি কমলা দেবী তাকে বুকের দুধ খাওয়াবেন, তবে শর্ত যে, রাজা কখনো রানিকে স্পর্শ করতে পারবেন না। রাজা গভীর রাতে সন্তানটিকে পুকুরের পাড়ে রেখে আসতেন আর রানি বুকের দুধ খাইয়ে আবার পানিতে চলে যেতেন। এই দৃশ্য রাজাকে খুব যন্ত্রণা দিত। একদিন মধ্যরাতে যখন রানি কমলা দেবী তার সন্তানকে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন, তখন রাজা জানকি নাথ কমলা দেবীকে ধরার জন্য এগিয়ে গেলেন। রানি রাজাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন। পরে রাজা রানির চুলে ধরলেন; কিন্তু রানিকে আর রাখতে পারলেন না। রানি পানিতে নেমে পানির সঙ্গে একাকার হয়ে গেলেন। এরপর থেকে আর শিশু সন্তানটিকে দুধ খাওয়াতে এলেন না। যতদূর জানা যায়, রাজা রঘুর আমলেই সুসং দুর্গাপুর শক্তিশালী পরগনা হিসাবে গণ্য হয়েছিল। এই রাজা রঘুই জঙ্গলবাড়ী দুর্গ আক্রমণ করেন এবং বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদ রায়, কেদার রায়কে পরাজিত করেন। পরে তিনি মোগল সম্রাটের কাছ থেকে মহারাজা উপাধি লাভ করেন।

জমিদার বাড়ি : দুর্গাপুর একসময় ছিল সুসং রাজ্যের রাজধানী। সোমেশ্বর পাঠক থেকে শুরু করে পরবর্তী বংশধররা প্রায় ৬৬৭ বছর ধরে এ রাজ্য শাসন করে। কিন্তু রাজকৃষ্ণ নামে এক রাজার শাসনামল থেকে রাজপরিবারে রাজ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত হয়। ফলে গোটা রাজ্য চারটি ভাগে ভাগ হয়ে যায় এবং চারটি পৃথক রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়। বাড়িগুলো হলো বড় বাড়ি, আবু বাড়ি, মধ্যম বাড়ি ও দু-আনি বাড়ি। বর্তমানে এসবের ভগ্নাবশেষ আছে। দু-আনি বাড়িতে সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

হাজং মাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ : বহেরাতরি গ্রামের সড়কের পাশে ঐতিহাসিক টংক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত তির-ধনুক আকৃতির স্মৃতিসৌধের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবময় অতীত সম্পর্কে জানান দেয়। সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত বগাঝরা গ্রামটি ব্রিটিশবিরোধী গ্রামগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেই গ্রামের একজন প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন রাশিমণি। তিনি টঙ্ক প্রথা ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। ১৯৪৬ সালে বহেরাতনি গ্রামের কিশোরী কুমুদিনী হাজংকে ব্রিটিশ পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে কৃষক সমিতির বিপ্লবী সদস্য রাশিমণি কুমুদিনীকে উদ্ধার করতে হাতে থাকা দা দিয়ে পুলিশকে কোপাতে থাকেন। এতে এক পুলিশ সদস্যের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন। কথিত আছে, কুমুদিনী হাজংকে বাঁচাতে যাওয়ার প্রেক্ষাকালে তিনি সহযোদ্ধাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, আমি নারী, আমি জানি নারীর সম্ভ্রমের মান। নারীর মান আমি রক্ষা করব, নয় মরব। তোরা থাক তোদের নীতি নিয়ে বসে।’

টঙ্ক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ : সুসং জমিদার বাড়ির ভাগিনা কমরেড মনি সিংহের নেতৃত্বে জমিদারদের বিরুদ্ধে শুরু হয় টঙ্ক আন্দোলন। এই আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয় টঙ্ক আন্দোলন স্মৃতিসৌধ। দুর্গাপুর পৌর শহরে মহারাজা কুমুদ চন্দ্র মোমেরিয়াল (এমকেসিএম) পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠের পাশেই এই স্মৃতিসৌধটি। প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর কমরেড মনি সিংহের মৃত্যু দিবস উপলক্ষ্যে সপ্তাহব্যাপী মেলা বসে এখানে।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *