Daily Manobkantha:: মিয়ানমারের বিরল খনিজ: চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের ত্রিমুখী লড়াই: Daily Manobkantha

Google Alert – আর্মি

আধুনিক প্রযুক্তির মূল চালিকাশক্তি বিরল খনিজ (রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস) এখন বৈশ্বিক ভূরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যের চিপওয়ে-পাংওয়া খনি অঞ্চলের সমৃদ্ধ হেভি রেয়ার আর্থ মজুত নিয়ে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ত্রিমুখী প্রতিযোগিতা তীব্র হয়ে উঠেছে। এই খনিজ শুধু অর্থনৈতিক সম্পদ নয়, বরং কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে, যা মিয়ানমারকে ভূরাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছে।

বিরল খনিজের গুরুত্ব

১৭টি ধাতুর সমন্বয়ে গঠিত রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস আধুনিক অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য। ডিসপ্রসিয়াম ও টার্বিয়ামের মতো ভারী ধাতু দিয়ে তৈরি চুম্বক বৈদ্যুতিক মোটর, সেমিকন্ডাক্টর, রাডার, ক্ষেপণাস্ত্র, স্মার্টফোন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়। এই খনিজ ছাড়া প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্ব অচল হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

চীনের একচেটিয়া আধিপত্য

বর্তমানে চীন বিশ্বের বিরল খনিজ উত্তোলনের ৭০ শতাংশ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের ৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। বৈশ্বিক চুম্বক উৎপাদনের প্রায় পুরোটাই বেইজিংয়ের হাতে। এই আধিপত্য যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইউরোপ ও ভারতকে চীনের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে। চীন এই নির্ভরতাকে কূটনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ২০২৫ সালের এপ্রিলে বিরল খনিজ ও চুম্বক রপ্তানি হঠাৎ বন্ধ করে দেয়ায় ভারতের বৈদ্যুতিক গাড়ি ও প্রতিরক্ষা শিল্পে সংকট দেখা দেয়।

কাচিনের খনি: নতুন ভূরাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্র

মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যের চিপওয়ে-পাংওয়া খনি অঞ্চলে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ হেভি রেয়ার আর্থ মজুত। ২০২৪ সালে এই অঞ্চল দখল করে কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি (কেআইএ), যারা ১৯৬১ সাল থেকে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়ছে। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর কেআইএ জান্তার বিরুদ্ধে প্রধান প্রতিরোধ শক্তি হয়ে ওঠে। এই খনিগুলো এখন কেবল অর্থনৈতিক সম্পদ নয়, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ারও বটে।

ত্রিমুখী প্রতিযোগিতা

চীনের ইউনান প্রদেশের নৈকট্যের কারণে কাচিনের খনিজ সহজেই চীনে প্রবাহিত হচ্ছে। তাদের উন্নত প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি ও অর্থায়ন এই প্রতিযোগিতায় তাদের শক্তিশালী অবস্থান দিয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (BRI) মিয়ানমার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কাচিনের খনিজ শুধু অর্থনৈতিক সম্পদ নয়, BRI-এর সাফল্য টিকিয়ে রাখার জন্যও অপরিহার্য।

ভারত তার অ্যাক্ট ইস্ট পলিসির মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বাড়াতে চাইছে, যার কেন্দ্রবিন্দু মিয়ানমার। রয়টার্সের তথ্যমতে, ভারতের খনি মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রায়ত্ত আইআরইএল ও বেসরকারি মিডওয়েস্ট অ্যাডভান্সড ম্যাটেরিয়ালসকে কাচিন থেকে খনিজ নমুনা সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছে। কেআইএ-র সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ভারতের জন্য বিরল হলেও, চীনের একচেটিয়া দখল ভাঙতে তারা এই পথ বেছে নিয়েছে। তবে, ভারতের সীমাবদ্ধতা হলো ভারী বিরল খনিজ প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রযুক্তি ও অবকাঠামোর অভাব। এজন্য তারা জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করছে।

যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব ঠেকাতে বিকল্প সরবরাহ শৃঙ্খল গড়তে চাইছে। ট্রাম্প প্রশাসন থেকেই মার্কিন কর্মকর্তারা মিয়ানমারের বিরল খনিজ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মিলে তারা এই শৃঙ্খল গড়ে তুলতে কাজ করছে, যা চীনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।

কেআইএ-র ভূমিকা

কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি এই প্রতিযোগিতায় ‘কিংমেকার’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। চীনের ওপর নির্ভরশীল হলেও তারা ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করে দর-কষাকষির নতুন সুযোগ তৈরি করছে। তবে, খনিজ আহরণে ব্যবহৃত ইন-সিচু লিচিং পদ্ধতি মাটি-পানি দূষণ, বন উজাড় এবং শ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের মতো গুরুতর পরিবেশ ও মানবাধিকার সমস্যা সৃষ্টি করছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ নিয়ে সতর্ক করলেও সশস্ত্র সংঘাতের কারণে এসব ইস্যু চাপা পড়ছে।

বাংলাদেশের ওপর প্রভাব

বাংলাদেশ সরাসরি এই প্রতিযোগিতায় না থাকলেও এর প্রভাব পড়বে চারটি ক্ষেত্রে:

ভূরাজনীতি: ভারত যদি কাচিন থেকে সরবরাহ শৃঙ্খল গড়ে, তা উত্তর-পূর্ব ভারতের ভেতর দিয়ে যাবে। এটি সীমান্ত স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশের নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলবে।

শিল্পোন্নয়ন: বৈদ্যুতিক যান, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে বিরল খনিজ অপরিহার্য। বাংলাদেশকে বিকল্প সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

অংশীদারত্ব: ভারত-জাপান-যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ শৃঙ্খলে বাংলাদেশ গবেষণা, প্রক্রিয়াজাতকরণ বা ট্রানজিট সুবিধায় অংশ নিতে পারে।

পরিবেশ ও ন্যায়: আঞ্চলিক দূষণ বাংলাদেশের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। পরিবেশ ও মানবাধিকার ইস্যুতে ঢাকার স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া জরুরি।

মিয়ানমারের কাচিন রাজ্য এখন শুধু খনিজের ভান্ডার নয়, বরং বৈশ্বিক ভূরাজনীতির নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিযোগিতার ফলাফল নির্ভর করছে খনিজের প্রাপ্যতা, আঞ্চলিক শান্তি, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং কূটনৈতিক দর-কষাকষির ওপর। বাংলাদেশের জন্য এই প্রতিযোগিতা থেকে দূরে থাকা সম্ভব নয়। বরং বিকল্প সরবরাহ নিশ্চিত করা, আঞ্চলিক সহযোগিতায় যুক্ত হওয়া এবং পরিবেশ-মানবাধিকার ইস্যুতে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া এখন সময়ের দাবি।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *